একটি প্রশ্ন নিয়ে সকলেই খুব চিন্তায় থাকেন, রাতের খাবারে কী খাবেন? বা কী খাওয়া উচিত ভাত না রুটি? বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্ধ্যের পরে কার্বো হাইড্রেড জাতীয় যেকোনো খাবার না খাওয়াই ভালো। বিশেষ করে, যাদের ডায়বেটিস রয়েছে তাদের জন্য কার্বো হাইড্রেড জাতীয় কোনো খাবার না খাওয়াই ভালো নয়। কিন্তু ভাত ও রুটি দুটোতেই কার্বো হাইড্রেড রয়েছে। তাহলে কোনটি খাওয়া শরীরের জন্য ভালো সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
যারা ভাত খেতে ভালোবাসেন তাদের তো ভাত না খেলে ঘুমই আসে না। আবার যারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন তারা রাতের খাবার হিসেবে রুটি বেছে নিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাতের বেলা ভাত বা রুটি কোনটিই খাওয়া সঠিক নয়।
ভাত যে কারনে খাবেন না? সন্ধ্যের পর কার্বো হাইড্রেড জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। আর ভাতে কার্বো হাইড্রেড রয়েছে। কার্বো হাইড্রেড জাতীয় খাবার রাতে বা সন্ধ্যের সময় বা ঘুমানোর আগে খেলে গ্রোথ হরমোন ও টেস্টোস্টরনটা শরীরে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলে। আর সে কারণেই রাতের বেলা ঘুমের ব্যঘাত ঘটতে পারে ও ঠিকমত হজমও হতে পারে না ।ভাতে ফাইবারের মাত্রা খুবই কম পরিমাণে থাকে। তাই হজম ক্ষমতা দুর্বল থাকলে রাতে ভাত সহজে হজম হবে না। তাই রাতে অতিরিক্ত মাত্রায় ভাত না খাওয়াই শরীরের জন্য ভালো।
রুটি যে কারনে খাবেন না? রুটিতেও রয়েছে কার্বো হাইড্রেড। একটি রুটিতে ১৫ গ্রাম পরিমাণে কার্বো হাইড্রেড থাকে। দৈনিক পুষ্টির মাত্রা ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ কার্বো হাইড্রেড থেকে নেয়া উচিত। তাই রুটি আপনি খেতে পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া উচিৎ না। যাদের ডায়বেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ভাত বা রুটি কোনটিই খাওয়া সঠিক নয়। তবে বেশি ক্ষুধা অনুভব হলে একটি রুটি খেতে পারেন। হজমের সমস্যা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকলে তাদের ক্ষেত্রেও রাতের বেলা অতিরিক্ত ভাত বা রুটি না খাওয়াই ভালো।
গর্ভকালীন মায়ের খাবার
মায়ের কাছ থেকেই তার গর্ভের সন্তান পুষ্টি পায়। অনাগত সন্তান আর মায়ের ভবিষ্যতের সুস্থতাও অনেক ক্ষেত্রে গর্ভকালীন খাবারের ওপর নির্ভর করে থাকে। অনেক মা দ্বিধায় ভোগেন কী খাওয়া উচিত, আর কী উচিত নয়। অনেকে চিন্তায় থাকেন বাড়তি ওজন নিয়েও। লিখেছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান আখতারুন নাহার আলো
একটি সুস্থ সন্তানের জন্মদানে ডাক্তারের যথেষ্ট ভূমিকা আছে, কিন্তু সেটাই প্রধান নয়। প্রকৃতপক্ষে একটি সুস্থ মা-ই পারেন একটি সুস্থ-সবল শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে। এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের শরীরের যত্ন নিতে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদরা সব সময় সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর খাবার যেমন পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যপ্রদ হবে, তেমনি তাঁকে নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। যে খাবার খাবেন তাও যথাযথ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে, যাতে কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত না হন।
গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য ঘাটতিতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের সন্তান হয় ওজনে কম ও লম্বায় ছোট। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভেই সন্তান মরে যায়, জন্মের কিছু সময় পর সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হয়, গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে, সময় হওয়ার আগেই সন্তানের জন্ম হয়ে যায়, ফলে শিশু থাকে অপরিণত। বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের খাবার নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তি যেমন আছে, তেমনি অজ্ঞতার ফলেও অনেকের পক্ষে উপযুক্ত খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না।
অনেক মানুষ মনে করেন, মা যদি বেশি খাবার খায় তাহলে গর্ভের সন্তান আকারে বড় হবে। তখন স্বাভাবিক ডেলিভারি সম্ভব হবে না। তাই অনেকেই গর্ভবতী মাকে কম খেতে দেয়। যা মা ও শিশুর জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে।
আবার অনেকে মনে করেন, একজন গর্ভবতী মাকে দুজনের খাবার খাওয়া উচিত। এটাও সঠিক নয়। কারণ অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের সঙ্গে মুটিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। অতিরিক্ত ওজনের মায়েদের ক্ষেত্রে মৃত সন্তান অথবা ছোট শিশুর জন্মদানের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। তবে খাবার যেমনই হোক না কেন, সেটা হতে হবে পুষ্টিকর। এ জন্য প্রতিদিনের খাবারে খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি থাকতে হবে।
প্রোটিন বা আমিষ
প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে দৈনিক ৯০-১০০ গ্রাম। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি পরিমাণে। এই পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যায় মাঝারি আকারের তিন টুকরা মাংস থেকে। প্রোটিন আসতে পারে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম, শিমের বিচি থেকেও। প্রোটিন গর্ভস্থ শিশুর কোষ ও মস্তিষ্কের সঠিক গঠনে সাহায্য করে। প্রোটিন মায়ের স্তনকোষ বাড়ায়। শ্রোণিচক্রকে সন্তান জন্মদানে উপযোগী করে তোলে।
ফ্যাট বা চর্বি
চর্বিজাতীয় খাবার শক্তির অন্যতম ভালো উৎস। এগুলো চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনকে কাজে লাগাতে সহায়তা করে। আর এসব ভিটামিন স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক গঠন নিশ্চিত করে থাকে। চর্বি পাওয়া যায় ঘি, মাখন, তেল, মাংসের চর্বি থেকেও।
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা
শর্করাজাতীয় খাবারও শরীরে শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। প্রচুর পরিমাণে শর্করা পাওয়া যায় ভাত, রুটি, চিঁড়া, মুড়ি, খই, আলু, চিনি, মিষ্টি ও গুড় থেকে। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলাই ঠিক হবে।
ক্যালসিয়াম
নবজাত শিশুর হাড় গঠনের জন্য গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি আছে এমন খাদ্য বেশি খেতে হবে। দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী ক্যালসিয়ামের উত্তম উৎস। তবে দুধ বেশি খেতে না পারলে ডাল, ছোট মাছ ইত্যাদি খেয়েও ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করা যায়। গর্ভকালীন শরীরে মোট দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।
ভিটামিন
ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘বি কমপ্লেক্স’ শিশুর দেহ গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া গর্ভকালীন সময়ে রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে বলে গর্ভের শেষদিকে ভিটামিন ‘কে’ শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। শিশুর হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ভিটামিন ‘ডি’ প্রয়োজন। কারণ এই ভিটামিন খাদ্যের ক্যালসিয়ামকে শোষণ করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ‘সি’ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই প্রয়োজন তাঁর নিজের ত্বক ও নবজাতকের ত্বক এবং চুলের জন্য। যেসব খাবার থেকে এ ধরনের ভিটামিন পাওয়া যাবে সেগুলো হলো দুধ, মাখন, ডিম, ছানা, কডলিভার অয়েল, ইলিশ মাছ, টমেটো, গাজর, পালংশাক, বিট, লালশাক, মাংস, বিভিন্ন ধরনের ডাল, আলু ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি যেমন কমলালেবু, টমেটো, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আমলকী, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি থেকে। দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।
লৌহ ও ফলিক এসিড
গর্ভ ধারণের আগেই ফলিক এসিড ও লৌহসমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত। কারণ গর্ভকালীন সময়ে এই দুটির ঘাটতি বেশি হতে দেখা যায়। লৌহ ও ফলিক এসিড আছে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, চালতা, গুড়, কলিজা, পাকা কলা, খেজুর, আম, টমেটো, তরমুজ, সবুজ শাকসবজি, কালো কচুর শাক ইত্যাদিতে। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রো গ্রাম ফলিক এসিড ও ২৭ মিলিগ্রাম লৌহ প্রয়োজন।
ক্যালরি
গর্ভবতী মায়েদের ক্যালরির প্রয়োজন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য প্রথম তিন মাসে খেতে হবে গর্ভ ধারণের আগে প্রতিদিন যতটুকু ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়েছেন ততটুকুই। পরবর্তী তিন মাসে প্রয়োজন দৈনিক অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি এবং শেষ তিন মাসে প্রয়োজন দৈনিক আরো ২০০ ক্যালরি। সুতরাং প্রথমে তিনি যদি ১৪০০ ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতেন, তাহলে তাঁকে দিতে হবে দ্বিতীয় তিন মাসে ১৪০০+৩০০=১৭০০ ক্যালরি, পরবর্তী তিন মাসে দিতে হবে ১৭০০+২০০=১৯০০ ক্যালেরিসমৃদ্ধ খাবার। যদি গর্ভবতী মা প্রথম তিন মাসে ১৬০০ ক্যালরি পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি শেষ তিন মাস পাবেন ২১০০ ক্যালরি। এই ক্যালরি বাড়ানো উচিত প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার থেকে। কারণ প্রোটিনযুক্ত খাবার দিয়েই ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
গর্ভকালীন ৯ মাসে শরীরের মোট ওজন বাড়া উচিত ১০ থেকে ১২ কেজি। এর চেয়ে বেশি বাড়লে সুস্থ সন্তান জন্মদানে যেমন প্রতিকূলতা দেখা দিতে পারে, তেমনি পরবর্তী সময়ে মায়ের ওজন স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনাও কঠিন হবে। তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
যাদের ওজন আগে থেকেই বেশি তাদের গর্ভকালীন ওজন পাঁচ থেকে আট কেজি পর্যন্ত বাড়ালেই হবে। যাদের ওজন আগে থেকে অনেক কম তাদের ওজন ১৫ কেজি পর্যন্ত বাড়লে কোনো সমস্যা নেই।
গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়েদের হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা যায়। ফলে হতে পারে রক্তস্বল্পতা। কারণ এ সময় গর্ভস্থ শিশুর দেহে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর মায়ের রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। বাংলাদেশে ৭৫ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা কোনো না কোনো মাত্রায় রক্তস্বল্পতায় ভুগেন। রক্তস্বল্পতার ফলে দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ বা ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা, মাথাঘোরা ইত্যাদি দেখা যায়। কলিজা, ডিমের কুসুম, মাংস, কালো ও সবুজ কচুর শাক, বিট, লেটুসপাতা, হলুদ ইত্যাদি খাওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রতিদিনই একটি বা দুটি টক ফল খাওয়া ভালো।
গর্ভাবস্থার সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি ভাগে খাবারের পরিমাণে কিছুটা তারতম্য করা উচিত। খাবার তালিকা ঠিক থাকলে সুস্থ ও সবল শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব। নিচে এ বিষয়ে একটি সাধারণ ধারণা দেওয়া হলো।
প্রথম তিন মাস দৈনিক ১৬০০ ক্যালরি
সকালের নাশতা
রুটি/পাউরুটি-৬০ গ্রাম=২ পিস
ডিম-একটা/ডাল-১০ গ্রাম
সবজি ইচ্ছামতো।
সকাল ১০-১১টা
মুড়ি/বিস্কুট/কেক ইত্যাদি-৬০ গ্রাম+ফল
দুপুরের খাবার
ভাত-দুই কাপ=২৪০ গ্রাম
মাছ/মাংস-৬০ গ্রাম
ডাল-আধা কাপ, মাঝারি ঘন
সবজি-ইচ্ছামতো।
বিকেলের নাশতা
নুডলস/ছোলামুড়ি/সেমাই ইত্যাদি-
৩০ গ্রাম
রাতের খাবার
দুপুরের মতো।
শোয়ার আগে
দুধ-১ কাপ
দ্বিতীয় তিন মাস দৈনিক ১৯০০ ক্যালরি
সকালের নাশতা
রুটি/পাউরুটি-৯০ গ্রাম=৩ পিস
ডিম-১টা/মাংস-২ টুকরা
সবজি-ইচ্ছামতো।
সকাল ১০-১১টা
দুধ-১ কাপ
বিস্কুট/মুড়ি/নুডলস ইত্যাদি-৩০ গ্রাম+ফল
দুপুরের খাবার
ভাত-৩০০ গ্রাম=আড়াই কাপ
মাছ/মাংস-৮০ গ্রাম
ডাল-১ কাপ, সবজি-ইচ্ছামতো।
বিকেলের নাশতা
সেমাই/নুডলস/ছোলামুড়ি/কেক ইত্যাদি-৪০ গ্রাম
রাতের খাবার
দুপুরের মতো।
শোয়ার আগে : দুধ-১ গ্লাস
শেষ তিন মাস দৈনিক ২১০০ ক্যালরি
সকালের নাশতা
রুটি/পাউরুটি-১২০ গ্রাম=৪ পিস
ডিম-১টা
সবজি-ইচ্ছামতো।
সকাল ১০-১১টা
দুধ-১ কাপ
যেকোনো নাশতা-৬০ গ্রাম+ফল
দুপুরের খাবার
ভাত-৩৬০ গ্রাম=৩ কাপ
মাছ/মাংস-১০০ গ্রাম
ডাল-১ কাপ, ঘন
সবজি-ইচ্ছামতো।
বিকেলের নাশতা
দুধ অথবা দুধের তৈরি নাশতা-৬০
গ্রাম অথবা ডালের তৈরি নাশতা।
রাতের খাবার
দুপুরের মতো।
শোয়ার আগে : দুধ-১ গ্লাস।